বেসরকারি টেলিভিশনের টক শো যারা দেখেন তারা নিশ্চয়ই মানবেন বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বেশ বাকপটু। যুক্তি দিয়ে কথা বলেন বিএনপির এই আইনজীবী নেত্রী। আবার কখনো কখনো যুক্তির বাইরে গিয়ে কথা বলতেও ছাড়েন না তিনি।
একাধিক টেলিভিশন টক শোতে একসঙ্গে অংশ নিয়েছি তার সঙ্গে। লক্ষ্য করেছি, তিনি হারতে চান না। সেখানে যুক্তি থাকুক আর না থাকুক। সেই রুমিন ফারহানা সংসদের নারী সংরক্ষিত আসনে শপথ নিয়েছেন। শপথ নিয়েই বললেন, সংসদ অবৈধ। আবার বললেন, প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়ে তিনি আনন্দিত।
প্রশ্নটা এখানেই। সংসদকে যিনি অবৈধ বলছেন, তিনিই আবার সেই সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য নির্বাচিত হলেন স্বেচ্ছায়। সুস্থ মস্তিষ্কে যিনি আবার শপথ নেওয়ার পর নিজের উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করলেন। পরক্ষণেই বললেন, খুশি হবো যদি একদিনের বেশি সাংসদ থাকতে না হয়। দাবি করলেন মধ্যবর্তী নির্বাচনেরও। এটি কি স্ববিরোধিতা নয়? শুধুই কি রুমিন ফারহানার স্ববিরোধিতা? নাকি বিএনপিরও?
আসলে এটি বিএনপির এক ধরনের দেউলিয়াপনারই প্রকাশ। যে সংসদকে অবৈধ বলছেন, যে নির্বাচনের ভোটকে বলা হচ্ছে আগের রাতের ভোট, সেই নির্বাচনে নির্বাচিত বিএনপির সাংসদদের শপথ ও সংসদে যোগদান নিয়েও কি স্ববিরোধিতাই না দলটি করলো।
দলের অন্যরা শপথ নিলো, সংসদেও যোগ দিলো। আর দলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন যিনি সেই মির্জা ফখরুলকে শপথ না নিতে কার্যত বাধ্য করা হলো। কেন এই দ্বিচারিতা?
বিএনপি বা রুমিন ফারহানারা আসলে কি চান? তাঁরা সংসদেই যখন গেলেন, তখন মির্জা ফখরুলকে বাদ দিয়ে কেন? যত দিন যাচ্ছে ততই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
তাহলে কি মির্জা ফখরুলকে নিয়ে বিএনপির অন্দরে বড় রাজনীতি হচ্ছে? তাই যদি না হবে ফখরুলের শূন্য আসনে তো বিএনপি উপনির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে। আর কে সেখানে তাদের প্রার্থী? বগুড়া সদরের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী করেছে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজকে। যিনি মনোনয়ন পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন বিএনপিতে। ১/১১’র সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যিনি প্রয়াত বিএনপি মহাসচিব ও দলটির সংস্কারপন্থীদের প্রধান সংগঠক মান্নান ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ছিলেন। শুধু কি তাই? জি এম সিরাজই প্রথম প্রকাশ্যে বিএনপিতে ইমাম (নেতা) পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মুখ খুলেছিলেন।
প্রশ্ন এখানেই যে, যিনি খোদ বেগম জিয়াকে নাড়িয়ে দিতে চাইলেন ১/১১’র সময়ে তিনি হলেন ’৯১ থেকে প্রতিটি নির্বাচনে (সর্বশেষ ছাড়া) দলের চেয়ারপারসনের আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী!
আর যিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মেনে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গলা ফাটাচ্ছেন, সেই মির্জা ফখরুল নির্বাচিত হয়েও আসন খালি করে দিতে বাধ্য হলেন। তবে কি বিএনপি মহাসচিব নিজ দলেই ঈর্ষার শিকার? বিএনপিতেই এই প্রশ্ন আছে; কেন্দ্র থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। কারা ঈর্ষা করছে মির্জা ফখরুলকে? কেন করছে? বিএনপি পরিচালনায় দলের স্থায়ী কমিটির কোনো ভূমিকাই নেই।
লন্ডন থেকে ফোনে দল চালান বাংলাদেশে ফৌজদারি আইনে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান। সংসদে যাওয়া, ফখরুলের শপথ না নেওয়া, বগুড়া সদরে বিএনপির নতুন করে উপনির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং সংস্কারপন্থী জি এম সিরাজকে ধানের শীষের প্রার্থী করা সবই নাকি তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্ত। তিনিই নাকি চাননি মির্জা ফখরুল সংসদে গিয়ে কথা বলুক। কী আশ্চর্য! এখন পর্যন্ত বিএনপিতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মুখই কি না এই ফখরুল।
সজ্জন, বিনয়ী। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলেন। গণমাধ্যমকেও সহজে মোকাবিলা করতে পারেন। সর্বোপরি সব মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। ফখরুল সংসদে গেলে, কথা বললে গণমাধ্যমসহ সব জায়গাতে বেশি ‘মাইলেজ’ পেতেন, এ কথা তো বলছেন বিএনপির অনেকেও।
তাহলে দল ও দলের বাইরে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠাই কি কাল হলো মির্জা ফখরুলের? তিনি সংসদে যাবেন, অফিসিয়ালি সংসদেও বিএনপির প্রধান মুখ হয়ে উঠবেন এটা মানতেই আপত্তি বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের।
অনেকদিন ধরেই শুনছি, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে একাধিক পক্ষ। সিনিয়র আর জুনিয়র গ্রুপ নাকি দলটিতে সবসময় সক্রিয়। মূলত তারেক রহমানই নাকি জুনিয়র গ্রুপকে নিজের বলে মনে করেন। ফখরুলকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সিনিয়র গ্রুপে। যেখানে আবার ব্যারিস্টার মওদুদ, ড. খন্দকার মোশাররফ, জমিরউদ্দীন সরকার, মির্জা আব্বাসদের সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে তাকে।
এই হলো বিএনপির অবস্থা। কার্যত প্রতিদিন যেভাবে বিএনপির মহাসচিব গণমাধ্যমে কথা বললে নিয়ম করে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও কথা বলেন, তা নজিরবিহীন। বিএনপি মহাসচিবকে কম গুরুত্বপূর্ণ দেখাতেই কি রিজভী একই দিন অন্য বিষয়ে কথা বলেন? নাকি এটিই দলটির নীতি? মহাসচিব যদি দলের মুখ হয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে কাজ করেন বা করতে বাধ্য হন তো সেই দলের বেহাল অবস্থা না হয়ে উপায় আছে কি?
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরবর্তী সময় সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি করে দেশের অর্থনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয় বিএনপি। এই দেউলিয়াপনা রাজনীতি কি দলকে এগিয়ে নেয়? নাকি পিছিয়ে দেয়? বিএনপি গাড্ডায় পড়েছে স্বেচ্ছায়, নিজের কর্মে। কর্মদোষে যে পিছিয়ে পড়েছে তাকে তো কর্মগুণেই এগোতে হবে। কিন্তু এমন কি ইতিবাচক কর্মসূচি বিএনপি নিয়েছে? জনগণ আকৃষ্ট হয় এমন কিছু কি বিএনপি দেখাতে পেরেছে?
উল্টো দণ্ডপ্রাপ্তকে দলের নেতৃত্বে জায়গা দিতে গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে দলটি। বার্তা পরিষ্কার, ফৌজদারি অপরাধ করে আদালত কর্তৃক সাজা পেলেও বিএনপির নেতা হতে কোনো বাধা নেই। এ তো অপরাধ, অপরাধীবান্ধব বার্তা! যে দলটি দেশ পরিচালনা করবে তারা যদি দলের গঠনতন্ত্রে দুর্নীতি, অপরাধকে এইভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বলে তাহলে এর চেয়ে বড় দেউলিয়াপনা আর কি হতে পারে? এই দলটির ওপর দেশের মানুষ আস্থা রাখবে? কেন? কীভাবে?
যে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দলীয় মহাসচিবকেই ঈর্ষা করে সেই দল এগোবেই বা কী করে? কষ্ট করবেন ফখরুল আর সংসদে যাবেন দলের নেতার (খালেদা জিয়া) পরিবর্তন চাওয়া জি এম সিরাজ। এটাই বা বিএনপির তৃণমূলের নেতারা কতটা ভালো চোখে দেখবেন? এই দেউলিয়াপনা নিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব কীভাবে দলের কর্মী এবং সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করবে? নির্বাচনকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, সংসদকে অবৈধ বলে আবার সেই সংসদের সকল সুযোগ-সুবিধা নেওয়াকেই বা জনগণ কি চোখে দেখবে? বিএনপির সাংসদরা কি শুল্কমুক্ত গাড়ি নেবেন? বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি গ্রহণ করবেন? নাকি তাদের ভাষায় সব রকম কথা বলার জন্য সংসদকে ‘গণতান্ত্রিক স্পেস’ হিসেবেই ব্যবহার করবে?
তো সেই ‘গণতান্ত্রিক স্পেস’ এ মির্জা ফখরুলকে কথা বলার সুযোগ থেকে বিরত রেখে বিএনপি সব মহলে কি বার্তা দিল? আবারও প্রমাণ করলো তাদের দেউলিয়াপনা। তাই নয় কি? বলি হলেন মির্জা ফখরুল। ঈর্ষার কাছে!
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।
সূত্র: ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম